চৈত্র পূজার নাচ গান ও চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব 3


জল, মাটি, আবহাওয়া ও মানুষের জীবিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাংলার লোকসংস্কৃতি। এই সমগ্র বাংলার রূপ রঙের সাথে মিশেছে কিছু সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, যাহা আজও আবহমান কাল আনন্দ ও সুখের সঞ্চার ঘটায়।  


ভৌগলিক অবস্থান ভেদে বর্ষ বিদায়-বরণের সন্ধিকাল চৈত্র সংক্রান্তিতে যেমন বৈচিত্র্যময় লোকজ ধারার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত করে। উত্তরাঞ্চলে চৈত্র সংক্রান্তিকে বলে বিষুয়া, চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিউ বা বিহু, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে সংগ্রাইন বা মাস পইলা পূজা, ময়মনসিংহ অঞ্চলে সাক্রাইন বা হাক্রাইন, ফরিদপুরে চত্তির পূজা আর খুলনায় দেউল বা দেল। বিভিন্ন অঞ্চলে বর্ষবরণ উৎসবের অনুসঙ্গ হিসেবে যে সকল লোকনৃত্য আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো উত্তরাঞ্চলের গোমিরা নাচ, খুলনা, যশোর, মাগুরা, নড়াইল, ঝিনাইদহ দেল বা দেউলের নাচ, গাজন নাচ ও অষ্টক নাচ, বরগুনায় নীলের নাচ, পুরান ঢাকায় শিব-গৌরীর নাচ উল্লেখযোগ্য। লোকনৃত্যগুলোকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে লোকগান বা পাঁচালী, মন্ত্র, বাজনা ও অভিনয় সহকারে দলবদ্ধভাবে পরিবেশিত হয়। কোন লোকনৃত্য আবার শুধু বাজনা বা হাত তালির মধ্যদিয়েও পরিবেশিত হয়।

চৈত্র সংক্রান্তিতে দেশের উত্তরাঞ্চলের কিছু কিছু এলাকায় পাতা নাচ, কালী কাচের নাচ ও পরী নাচ দেখা যায়। পাতা নাচ দেখা যায়। পাতা নাচকে স্থানভেদে বারাম বা ঘোড়া নাচও বলা হয়। পাতা নামায় বর বা মানত করলে তা পূরণ হয়- এই লোক বিশ্বাস থেকে পাতা নাচ অনুষ্ঠিত হয়। অধিকাংশ সময় শ্মশানে পাতা নাচ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শুধু নির্দিষ্ঠ সংখ্যক ভক্তই যেতে পারে। চৈত্র সংক্রান্তির শেষ রাতে একটি দল শ্মশানে গিয়ে চামুণ্ডার নৃত্যসহ নানা ধরনের পাতা নাচ পরিবেশন করে। নাচে বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রের মধ্যে কালি, চামুণ্ডা, হনুমান, প্রেত, দুর্গা প্রভৃতির মুখোশ ব্যবহৃত হয়। পাতা নৃত্যে ভক্তরা প্রেতিনী বা ডাকিনীর রূপসজ্জা গ্রহণ করে। পরনে থাকে রঙ্গীন বস্ত্র, নানাবিধ গহনা, ফুলের মালা। ঢাকের বাদ্যর তালে তালে পাতা নাচ চলতে থাকে।
চৈত্র সংক্রান্তির শেষ রাতে পরী নাচ পরিবেশিত হয়ে থাকে। একজন ভক্ত মুখোশ আর শাড়ি পরে আগুনের থালা হাতে নাচতে থাকে। ঢাকের বাজনার তালে তালে পরী সাজের ভক্ত লাফিয়ে নাচতে থাকে এবং কয়েকজন ভক্ত তাকে ঘিরে পাহারা দেন। বাজনার তালে ক্রমাগত পরী নাচের উন্মাদনা বাড়তে থাকেন। এক সময় জ্ঞান হারিয়ে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়তে যায়।

কালী কাচের নাচে অন্ধকার থেকে কালির মুখোশ পরা দুটি জীবন্ত কালিরূপী অভিনেতার আবির্ভাব ঘটে মন্দিরে। কালি সাজে ভক্তদের পরনে থাকে শাড়ি। তাদের এক হাতে লোহার তরবারি অন্য হাতে মাটির বড় ঢাকনী পাত্র। বাজনার তালের সাথে তাদের যুদ্ধ চলতে থাকে। যুদ্ধের চারদিকে মশাল জ্বেলে পাহারা বসায় ভক্তরা। এই যুদ্ধের কালীরূপী দুইজন ভক্তই এক সময় কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পরে যায়।
দক্ষিণাঞ্চল তথা খুলনা, যশোর, মাগুরা, নড়াইল, ঝিনাইদহ, ফরিদপুরে দেল বা দেউলের নাচ, গাজন নাচ, খেজুরভাঙ্গা নাচ ও অষ্টক নাচ দেখা যায়।
খুলনা, ফরিরদপুরে চৈত্র সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে দেল বা দেউলপূজা হয়। ‘দেল’ হলো মহাদেবের অর্ধশায়িত ভঙ্গির মূর্তি। যোগীরা শিবপূজায় শিবের পাঁচালি পাঠ করে। পাঁচালি পাঠ করা হতো গানের মতো সুরে সুরে। পাঁচালি গায়কদের পায়ে নূপুর থাকত, নূপুর পায়ে তারা নেচে নেচে শিবের গান করত। পাঁচালি গায়কদের বলা হতো ‘বালা’ এবং সে গানকে বলা হতো ‘বালাকি গান’।
চৈত্র সংক্রান্তিতে নড়াইল, যশোর ও খুলনার কোনো কোনো এলাকায় শিবের গাজন প্রচলিত আছে। গাজন হলো, গা অর্থ গ্রাম আর জন অর্থ মানুষ। গাজন অর্থ গ্রামের মানুষের উৎসব। সন্ন্যাসীরা চৈত্র মাস ধরে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে গাজনের দল নিয়ে গাজন নাচ পরিবেশন করে। এসময় শিব পূজা বা চড়ক উপলক্ষে চতুর্থাশ্রম বা সন্ন্যাসীরা ঢাক ও কাঁসর বাজিয়ে তা-ব নৃত্যসহ সম্মিলিত কণ্ঠে শিবের গাজন পরিবেশন করে। গাজনের দলের একজনকে জটাধারী শিব আবার কোন কোন দলে গৌরী বা পার্বতীও সাজিয়ে নিয়ে বেড়ায়। দলের অন্যদেরও থাকে বিচিত্র ঢঙের সাজ এবং বহুরূপী নাচও পরিবেশন করে। 
বৃহত্তর খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও বরিশাল অঞ্চলে জনপ্রিয় অষ্টক গানের সাথে নাচও হয়। নীলের গাজন উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী বিভিন্ন ধরনের গান গাওয়া হয়। সে গানেরই একটি শাখা হলো অষ্টক গান। শিবকে নিয়ে যেমন গাজন গান আর অষ্টক গানে শিবের সাথে রাধাকৃষ্ণের লীলাও থাকে। দশ থেকে বার জনের একটি দল ঢোল, মৃদঙ্গ, হারমোনিয়াম, মন্দিরা বাজিয়ে অষ্টক গান পরিবেশন করে। গানের সাথে সাথে দুটি দলে ভাগ হয়ে তারা নাচ পরিবেশন করে।

চড়কের অবিচ্ছেদ্য অংশ দেল পূজা, অষ্টক, নীল পূজা বা শিবের গাজন হলেও স্থানভেদে এগুলোর লোকাচার আর নাচের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ঠ্য।
বৃহত্তর খুলনার উল্লেখযোগ্য লোকাচার হলো খেজুরভাঙা। এসময় খেজুরভাঙ্গার নাচ পরিবেশিত হয়। চার জন যুবকের একটি দল খালি পায়ে একটি খেজুর গাছের চূড়ায় ওঠে। যুবকরা যখন দলবেঁধে খেজুর ভাঙার উদ্দেশ্যে গাছের মাথায় উঠার চেষ্টা শুরু করেন তখন গাছটির তলায় একটি দল নাচ গান করতে থাকে। যুবকরা মন্ত্র জপ করতে করতে দু’পায়ে দুমড়ে মুষড়ে একাকার করে দেয় খেজুর গাছের সব পাতা। এসময় কেউ কোন শব্দ উচ্চারণ করে না। এই গাছের খেজুরকে পুণ্যের প্রতীক মনে করা হয়। মাঠের মধ্যে কাদামাটি দিয়ে কুমির ও হনুমানের মূর্তি বানিয়ে সেসব খেজু গেঁথে দেওয়া হয় তার শরিরে।
বরগুনা, পিরোজপুরসহ বরিশাল অঞ্চলে নীল পূজা বা নীলের গাজন দেখা যায়। শিব আরেক নাম হলো নীলকণ্ঠ। নীলকণ্ঠের পূজা হলো নীল পূজা বা নীলোৎসব। কেউ কেউ বলেন নীলের গাজন। এসব উৎসব উপলক্ষে সংক্রান্তি বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই ভক্তরা দেল, চড়ক নিয়ে, শিব-গৌরী সেজে বাড়িতে বাড়িতে নেচে গেয়ে বেড়ায়।
চৈত্র সংক্রান্তির প্রধান উৎসব চড়ক পূজা। চড়ক গাজন উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ। দেশের বিভিন্ন এলাকায় চড়কপূজায় গ্রামের এক শিবের থান থেকে শোভাযাত্রা করে অন্য শিবের থানে যাওয়া হয়। একজন শিব ও একজন গৌরী সেজে নৃত্য করে এবং অন্য ভক্তরা নন্দি, ভৃঙ্গী, ভূত প্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতি সেজে শিব-গৌরীর সঙ্গে নেচে চলে। এই নাচকে চড়কের নাচ বা শিব-গৌরীর নাচ বলা হয়।
শিব-গৌরীর নাচ আরও দেখা যায় পুরান ঢাকার হিন্দুপ্রধান এলাকায়। চৈত্র সংক্রান্তির রাতে শিব-গৌরীর নাচ ও লোকাচার সহ পূজা-অর্চনা করা হয় এই এলাকার বাড়িতে বাড়িতে।
ঢাকা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, কুমিল্লা, দিনাজপুরসহ দেশের অধিকাংশ এলাকায় চৈত্রসংক্রান্তিতে কালী নাচ দেখা যায়। কালীর মুখোশ বা রং কালিতে কালী সেজে দুহাতে দুটি তরবারি নিয়ে ঢাকের বাজনার তালে তালে বিচিত্র তা-ব রসের এই নাচ পরিবেশন করে। নাচের শেষ পর্যায়ে শিবের বুকে পা দিয়ে জিহ্বা বের করে। এই নাচের সাথে কালির সাথে ভূত, প্রেত, শিব, গৌরী চরিত্রও দেখা যায়।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে চৈত্র সংক্রান্তিতে বা তার পরেও বালি নাচ দেখা যায়। বালি খেলা বা কুস্তির লড়াইতে দুজন প্রতিযোগী বাজনার তালে তালে পায়তারা করে। এই পায়তারাটুকু অর্ধ চন্দ্রাকারে একে অপরের মুখোমুখো বিপরীত গতিতে তাদের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ, তালুটুকা, হুঙ্কার, হাতের কসরত ও চোখের ক্রুব্ধ চাহনি প্রদর্শন করে। কুস্তির পূর্বে পায়তারার অংশটুকু প্রকৃতপক্ষে নাচের অংশ। চট্টগ্রাম অঞ্চলে এটাই বালি নাচ।
মানুষ বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণ উৎসবের সন্ধিকাল চৈত্রসংক্রান্তি পালন করে আসছে নানা আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। বিগত বছরের গ্লানি মুছে দিয়ে, নতুন সম্ভাবনাময় বছরের প্রত্যাশায় পালন করে আসছে এসব লোকাচার। এসব লোকাচারের বিভিন্ন অনুসঙ্গের মত লোকনৃত্যগুলো দীর্ঘ পরিভ্রমণ ও পর্যবেক্ষণের মধ্যদিয়ে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের মাধ্যমে পালিত হচ্ছে নাগরিক জীবনেও। লোকনৃত্যগুলো কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে উত্তরাঞ্চলের গোমিরা নাচ, চট্ট্রগ্রামের বালি নাচের মতই ধর্মীয় পরিম-লের বাইরে এসে সর্বজনীন বিশুদ্ধ লোক-উৎসবে পরিণত হয়।

Post a Comment

0 Comments